আল কুরআন: বাংলা অনুবাদ, আবদুস শহীদ নাসিম, Chapter: 12, ইউসুফ - Aajan.com

Go Back
Book Id: 10030

আল কুরআন: বাংলা অনুবাদ, আবদুস শহীদ নাসিম

Chapter: 12, ইউসুফ

মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত সংখ্যা: ১১১, রুকু সংখ্যা: ১২

এই সূরার আলোচ্যসূচি

আয়াতআলোচ্য বিষয়
০১-০২কুরআন মজিদ আরবি ভাষায় নাযিল করা হয়েছে রসূলের শ্রোতাদের বুঝার জন্য।
০৩-০৬কুরআনের সর্বোত্তম কাহিনী ইউসুফের কাহিনী। ইউসুফের স্বপ্ন ও তাঁর পিতার সতর্কবাণী।
০৭-২০ইউসুফের বিরুদ্ধে তার ভাইদের ষড়যন্ত্র। তাঁকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ। পিতার কাছে ইউসুফের ভাইদের বানোয়াট বক্তব্য। ব্যবসায়ী দল কর্তৃক ইউসুফকে উদ্ধার এবং মিশরে নিয়ে বিক্রয়।
২১-২২ইউসুফের জীবনে সৌভাগ্যের দ্বার উন্মুক্ত।
২৩-৩৫ইউসুফের বিরুদ্ধে নারীদের ষড়যন্ত্র এবং তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ।
৩৬-৪২কারাগারে ইউসুফের দাওয়াতি কার্যক্রম। দুই বন্দীর স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান।
৪৩-৫৩ইউসুফ কর্তৃক মিশর সম্রাটের স্বপ্নের ব্যাখ্যাদান। ইউসুফের ব্যাপারে সম্রাটের আগ্রহ। ইউসুফের শর্ত। ইউসুফের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত।
৫৪-৫৭মিশর সম্রাট কর্তৃক ইউসুফকে ক্ষমতাধর মন্ত্রী নিয়োগ।
৫৮-৯৩ইউসুফের ভাইদের মিশরে ইউসুফের কাছে খাদ্য সামগ্রীর জন্য আগমন। তারা ইউসুফকে চিনতে পারেনি, ইউসুফ তাদের চিনতে পারেন।
৯৪-১০১ইউসুফের ভাইয়েরা ইউসুফের পরিচয় অবগত হয়। ইউসুফ পিতা মাতা ও গোটা পরিবারবর্গকে মিশরে নিয়ে আসেন। ইউসুফের ছোটবেলার স্বপ্ন সত্য প্রমাণিত হয়। আল্লাহর প্রতি ইউসুফের কৃতজ্ঞতা।
১০২-১১১মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি আল্লাহর উপদেশ। নবী চাইলেও অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনবেনা। অধিকাংশ ঈমানদার লোকই মুশরিক। নবীর চলার পথ। সকল নবী একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।
12-1 : আলিফ লাম রা। এগুলো স্পষ্টভাষী আল কিতাবের (আল কুরআনের) আয়াত।
12-2 : এটিকে আমরা ‘আরবি কুরআন’ বানিয়ে পাঠিয়েছি, যাতে করে তোমরা (সহজেই) বুঝতে পারো।
12-3 : তোমার কাছে অবতীর্ণকুরআনের সেরা কাহিনী সমূহের একটি এখন তোমাকে বলছি। এর আগে তুমি এ বিষয়ে না জানা লোকদেরই একজন ছিলে।
12-4 : (ঘটনার শুরু তখন থেকে) যখন ইউসুফ তার পিতাকে বলেছিল: ‘আব্বু! আমি স্বপ্ন দেখেছি: এগারটি গ্রহ এবং সূর্য আর চাঁদ। আমি দেখলাম, তারা সবাই আমাকে সাজদা করছে (আমার প্রতি অবনত হয়ে আছে)।’
12-5 : (স্বপ্নের বিবরণ শুনে তার পিতা ইয়াকুব বললো): ‘‘পুত্র আমার! তোমার এ স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের বলোনা। তাহলে তারা তোমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। আর শয়তান তো অবশ্যি মানুষের সুস্পষ্ট দুশমন (হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে)।
12-6 : এমনটিই হবে, তোমার প্রভু তোমাকে (নবুয়্যতের) জন্যে উপযুক্ত করবেন, বক্তব্যের তাৎপর্য উপলব্ধির শিক্ষা দান করবেন এবং তোমার প্রতি আর ইয়াকুবের উত্তর পুরুষদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন, যেভাবে তা পূর্ণ করেছিলেন তোমার পিতামহ ইবরাহিম ও ইসহাকের প্রতি। অবশ্যি তোমার প্রভু সব বিষয়ে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়।’’
12-7 : ইউসুফ আর তার ভাইদের ঘটনাতে প্রশ্নকারীদের জন্যে রয়েছে (নিজেদের কৃতকর্মের পরিণতি উপলব্ধির) প্রমাণ।
12-8 : (সেই ঘটনার সূচনা হয় এভাবে যে,) ইউসুফের (সৎ) ভাইয়েরা নিজেরা নিজেরা বলাবলি করছিল: ‘‘আমাদের বাবার কাছে ইউসুফ আর তার সহোদর ভাইটি (বিনইয়ামিন) আমাদের চেয়ে বেশি প্রিয়। অথচ আমরা হলাম (দশ ভাইয়ের) একটি সংঘবদ্ধ (শক্তিশালী) দল। আসলে আমাদের পিতা (ইউসুফ আর তার ভাইকে আমাদের উপর প্রাধান্য দিয়ে) সুস্পষ্ট ভুল করছেন।
12-9 : চলো, ইউসুফকে মেরে ফেলো, কিংবা কোথাও ফেলে রেখে আসো। তবেই তোমাদের পিতার দৃষ্টি শুধু কেবল তোমাদের প্রতি নিবদ্ধ হবে। এই (অপরাধের) কাজটি সেরে ফেলার পর তোমরা ভালো মানুষ হয়ে যেয়ো।’’
12-10 : এ সময় তাদের একজন বললো: ‘ইউসুফকে একেবারে জানে মেরে ফেলোনা, বরং যদি কিছু করতেই হয়, তবে কোনো কুয়ার তলায় ফেলে আসো, তাতে করে কোনো পথিক দল তাকে তুলে (দূর দেশে) নিয়ে যাবে।’
12-11 : (এই সলা পরামর্শের পর পিতার কাছে) গিয়ে তারা বললো: ‘‘বাবা! ইউসুফের ব্যাপারে আপনি আমাদের উপর আস্থা রাখেননা কেন? অথচ আমরা তো ইউসুফের কল্যাণই কামনা করি।
12-12 : আগামিকাল ওকে আমাদের সাথে পাঠান, ফলমূল পেড়ে খাবে, দৌড় দোপ করবে, এভাবে মনটাকে চাংগা করবে। আমরা অবশ্যি তার হিফাযত করবো।’’
12-13 : তাদের পিতা বললো: ‘আমার আশংকা হয়, তোমরা তাকে নিয়ে গিয়ে তার ব্যাপারে অমনোযোগী হয়ে পড়বে আর সে সুযোগে নেকড়ে এসে তাকে খেয়ে ফেলবে, এই ভাবনাটাই বিষন্ন করে তুলছে আমাকে।’
12-14 : তারা বললো: ‘আমরা একটি শক্তিশালী দল থাকা সত্ত্বেও যদি তাকে নেকড়ে খেয়ে ফেলে, তবে তো আমরা একেবারেই ব্যর্থ।’
12-15 : এভাবে (পিতার উপর একটা মানসিক চাপ প্রয়োগ করে) তারা যখন তাকে নিয়ে গেলো এবং তাকে কূপের তলায় নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিলো (এবং নিক্ষেপ করলো)। তখন আমরা তার কাছে অহি (বার্তা) প্রেরণ করলাম: ‘এমন একদিন অবশ্যি আসবে, যখন তুমি তাদের এই অপকর্মের কথা তাদের সামনে তুলে ধরবে, অথচ তারা তোমার পরিচয় বুঝতে পারবেনা।’
12-16 : তারা এশার সময় কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিতার কাছে এসে উপস্থিত হয়।
12-17 : তারা বলে: ‘আমরা তো সত্য বললেও আপনি কখনো আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন না, (আমরা সত্যই বলছি) ইউসুফকে আমাদের মালপত্রের কাছে রেখে আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম, এই ফাঁকে নেকড়ে এসে ওকে খেয়ে ফেলেছে।’
12-18 : তারা (পিতার কাছে নিজেদেরকে সত্যবাদী প্রমাণ করার জন্যে) ইউসুফের জামায় মিথ্যা রক্ত মেখে নিয়ে এসেছিল। তাদের পিতা বললো: ‘(না, তা নয়) বরং তোমাদের মন তোমাদেরকে একটা কাহিনী সাজিয়ে দিয়েছে। আর আমার জন্যে ধৈর্য ধারণ করাই উত্তম। তোমরা যে (মিথ্যা) কাহিনী সাজিয়েছো, তার মোকাবেলায় একমাত্র আল্লাহ্ই (আমার) সাহায্যের মালিক।’
12-19 : এদিকে (ইউসুফকে নিক্ষেপ করা কূপের নিকট) এসে থামলো একদল পথিক। তারা তাদের পানি সংগ্রহকারীকে (পানির জন্যে কূপের দিকে) পাঠিয়ে দেয়। সে গিয়ে তার বালতি (bucket) ফেলে কুয়োতে। (ইউসুফকে দেখে) সে বিস্ময়ে বলে উঠে: ‘দারুণ সুখবর, (দেখে যান) এখানে এক বালক!’ তারপর তারা তাকে একটি পণ্য বিক্রয়ের মাল (দাস) হিসেবে লুকিয়ে রাখে। তারা (তাকে নিয়ে) যা কিছু করছিল, সে বিষয়ে আল্লাহ ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন।
12-20 : অবশেষে তারা তাকে বিক্রি করে ফেলে সামান্য দামে, মাত্র কয়েক দিরহামে। আসলে তারা ছিলো তার ব্যাপারে অপ্রত্যাশী।
12-21 : মিশরের যে ব্যক্তি তাকে ক্রয় করে নেয়, সে তার স্ত্রীকে বলেছিল: ‘একে সুন্দর ও সম্মানজনকভাবে রাখো, সে আমাদের জন্যে উপকারী হবার সম্ভাবনা আছে, অথবা আমরা তাকে আমাদের ছেলেই বানিয়ে নেবো।’ এভাবে আমরা ইউসুফকে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত হবার জায়গা করে দেই এবং যাবতীয় পরিস্থিতি ও ঘটনাবলির তাৎপর্য উপলব্ধি করার ব্যবস্থা করি। আল্লাহ তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেই থাকেন। তবে অধিকাংশ মানুষ তা জানেনা।
12-22 : সে (ইউসুফ) যখন পূর্ণ যৌবনে, পূর্ণ বয়সে (full manhood - এ) উপনীত হয়, আমি তাকে প্রদান করি প্রজ্ঞা এবং জ্ঞান (নবুয়্যত)। আর এভাবেই আমি উপকারী পুণ্যবান লোকদের পুরস্কার দিয়ে থাকি।
12-23 : এদিকে যে মেয়ে লোকটির ঘরে সে (ইউসুফ) অবস্থান করছিল, সে তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার পথ অবলম্বন করে। একদিন তো সে ঘরের সব দরজা বন্ধ করে দিয়েই (ইউসুফকে) আহবান জানায়: ‘ওহে, এসো।’ সে (ইউসুফ) বললো: ‘আমি (এমন কর্ম থেকে) আল্লাহর আশ্রয় চাই। তিনিই আমার প্রভু। অতি উত্তম মর্যাদা তিনি আমাকে দান করেছেন (একাজ করা আমার পক্ষে অসম্ভব)। আর অন্যায়কারীরা তো কিছুতেই সাফল্য অর্জন করেনা।’
12-24 : মেয়েলোকটি তো তার প্রতি আসক্ত হয়েই ছিলো, আর সেও তার প্রতি আসক্তিতে জড়িয়ে পড়তো, যদি তার প্রভুর স্পষ্ট প্রমাণ (evidence) তার দৃষ্টি পথে না থাকতো। এটা করা হয়েছে এজন্যে, যেনো এ পন্থায় আমি তার থেকে অন্যায় ও অশ্লীলতা দূর করে দিতে পারি। অবশ্যি সে ছিলো আমার নির্বাচিত দাসদের একজন।
12-25 : সুতরাং তারা একজন আরেকজনের পেছনে দরজার দিকে দৌড়ায়, আর মেয়েলোকটি পেছন থেকে ইউসুফের জামা টেনে ধরে ছিড়েঁই ফেলে এবং (দৌড়ে এসে দরজায় পৌঁছুতেই) তারা তার কর্তাকে (স্বামীকে) দরজায় দেখতে পায়। তাকে দেখে মেয়েলোকটি বলে উঠে: ‘যে তোমার স্ত্রীর প্রতি অসৎ কর্মের ইচ্ছা পোষণ করে, কারাগারে নিক্ষেপ করা কিংবা কঠিন শাস্তি দেয়া ছাড়া তার আর কী প্রতিবিধান হতে পারে?’
12-26 : তখন ইউসুফ বললো: ‘উনি আমাকে অসৎ কর্মে জড়িত করার চেষ্টা করেছেন।’ (দুইজনের দুই রকম কথার প্রেক্ষিতে) মেয়েলোকটির পরিবারেরই একজন এ বিষয়ে সাক্ষ্য (ফায়সালা) দেয়: ‘‘ইউসুফের জামা যদি সামনের দিকে ছিড়ে গিয়ে থাকে তবে আপনার স্ত্রীর কথাই ঠিক এবং ইউসুফের বক্তব্য অসত্য।
12-27 : আর ইউসুফের জামা যদি পেছন দিকে ছিড়েঁ গিয়ে থাকে, তবে আপনার স্ত্রীর কথা অসত্য এবং ইউসুফের বক্তব্য সঠিক।’’
12-28 : তার স্বামী যখন দেখলো, ইউসুফের জামা পেছন দিকে ছেঁড়া, তখন সে বলে উঠলো: ‘‘অবশ্যি এটা তোমাদের নারীদেরই ষড়যন্ত্র। নি:সন্দেহে তোমাদের নারীদের ছলনা - চক্রান্ত ভীষণ ব্যাপার।’
12-29 : হে ইউসুফ! তুমি বিষয়টি উপেক্ষা করো। আর হে আমার স্ত্রী! তুমি তোমার অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাও। কারণ, অবশ্যি তুমি অপরাধী।’’
12-30 : (এ ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়লে) নগরীতে একদল নারী বলাবলি করতে থাকে: ‘আযীযের স্ত্রী তার যুবক দাসের প্রতি আসক্ত হয়েছে! প্রেম তাকে পাগল করে ছেড়েছে। আমাদের মতে সে পরিষ্কার ভুল পথে পা বাড়িয়েছে।’
12-31 : (আযীযের স্ত্রী) যখন তাদের এই অভিযোগ শুনতে পায়, সে তাদের ডেকে পাঠায় এবং তাদের জন্যে একটি ভোজ উৎসব - এর আয়োজন করে। (খাবার সামগ্রী কেটে খাবার জন্যে) সে প্রত্যেকের সামনে একটি করে ছুরি রেখে দেয়। (অতপর তারা কেটে কেটে খেতে আরম্ভ করলে) সে ইউসুফকে বলে: ‘এদের সামনে বেরিয়ে এসো।’ তারা যখন ইউসুফকে দেখলো, তাকে অতি উচ্চ, মহিমান্বিত পেয়ে অভিভূত ও উত্তেজিত (exalted) হয়ে পড়ে এবং নিজেদের হাত কেটে ফেলে! তারা বলে উঠে: ‘হায় আল্লাহ, এ - তো মানুষ নয়, এ - তো এক সম্ভ্রান্ত (noble) ফেরেশতা!’
12-32 : (এবার আযীযের স্ত্রী বলে উঠে: ‘এ হলো সেই যুবক, যার ব্যাপারে তোমরা আমাকে তিরস্কার করছিলে। হ্যাঁ, একেই আমি আমার কামনায় জড়িত করতে চাইছি, কিন্তু সে আমার আহবান প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। এরপরও যদি সে আমি যা করতে বলি তা না করে, তবে অবশ্যি তাকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হবে এবং তখন হবে সে চরম লাঞ্ছিত - অপদস্ত।’
12-33 : ইউসুফ (মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করে) বললো: ‘আমার প্রভু! এই নারীরা আমাকে যে কাজের দিকে ডাকছে, তা থেকে কারাগারই আমার অধিক প্রিয়। (প্রভু!) তুমি যদি এদের ছলনা - চক্রান্ত আমার থেকে সরিয়ে না নাও, তবে তো আমি এদের ছলনার ফাঁদে ফেসে যাবো আর অন্তরভুক্ত হয়ে পড়বো জাহিলদের!’
12-34 : তখন তার প্রভু (মহান আল্লাহ) তার দোয়া কবুল করেন এবং সেই নারীদের ছলনা - ষড়যন্ত্র থেকে তাকে রক্ষা করেন। (কারণ) তিনি তো সবই শুনেন, সবই জানেন।
12-35 : (ইউসুফের নিষ্কলুষতা আর নিজেদের নারীদের ছিনালি ও অসতিপনার) পরিস্থিতি ও প্রামাণাদি দেখার পর তারা ভাবে, কিছুকালের জন্যে অবশ্যি ইউসুফকে জেলে রাখতে হবে (এবং তারা তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়)।
12-36 : আর তার সাথে কারাগারে প্রবেশ করে দুই যুবক (রাজ কর্মচারি)। একদিন (তারা ইউসুফের কাছে আসে এবং) তাদের একজন বলে: ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি, আমি মদ তৈরি করছি।’ আর অপরজন বলে: ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি, আমার মাথায় রুটি বহন করছি আর তা থেকে (ঠোকর মেরে মেরে) খাচ্ছে পাখিরা।’ (দুজনেই বললো:) ‘আমাদেরকে এর তা’বির (তাৎপর্য) বলে দিন। আমাদের দৃষ্টিতে আপনি একজন অতি উত্তম মানুষ।’
12-37 : ইউসুফ (তাদের কথা শুনে) বললো: ‘‘তোমাদের যে খাবার এখানে দেয়া হয়, তা আসার আগেই আমি তোমাদের স্বপ্নের তাৎপর্য বলে দেবো। (তাই এর মধ্যে তোমরা কয়েকটি জরুরি কথা শুনো), আমি যে কথাগুলো তোমাদের বলবো, সেগুলো আমার প্রভু (আল্লাহ) আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। আমি বর্জন করেছি সেইসব লোকদের মত ও পথ, যারা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখেনা এবং আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাসী।’’
12-38 : ‘‘আমি অনুসরণ করছি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহিম, ইসহাক, ও ইয়াকুবের মতাদর্শ। (সেই আদর্শ হলো:) আমরা আল্লাহর সাথে কারো কোনো অংশিদারিত্ব আরোপ করতে পারিনা। আসলে এটা আমাদের এবং গোটা মানবজাতির প্রতি আল্লাহর এক বিরাট অনুগ্রহ (যে, তিনি মানুষকে একমাত্র তাঁর ছাড়া আর কারো দাস হিসেবে সৃষ্টি করেননি।) তা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষই তাঁর শোকর আদায় করেনা।’’
12-39 : ‘‘হে আমার প্রিয় কারা - সাথিরা! (তোমরাই বলো:) বহু স্বতন্ত্র (দুর্বল - অক্ষম) খোদা ভালো, নাকি এক দুর্জয় অপ্রতিরোধ্য মহান আল্লাহ ভালো?’’
12-40 : ‘‘তাঁকে ছাড়া তোমরা যাদের ইবাদত - উপাসনা করছো, তারা তো তোমাদের আর তোমাদের পিতৃপুরুষদের আরোপিত কতোগুলো নাম ছাড়া আর কিছু নয়। এদের (খোদা হবার) পক্ষে তো আল্লাহ কোনো অনুমতি - অধিকার প্রদান করেননি। আল্লাহর ছাড়া আর কারো কোনো কর্তৃত্ব নেই। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন: তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো ইবাদত (আনুগত্য, দাসত্বউপাসনা) করোনা। এটাই জীবন যাপনের সরল সঠিক পথ। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই বিষয়টি জানেনা।’’
12-41 : ‘‘হে আমার কারা - সাথিরা! (তোমাদের স্বপ্নের তাৎপর্য হলো:) তোমাদের একজন (চাকুরিতে ফিরে গিয়ে) নিজের মনিবকে মদ্যপান করাবে, আর অপরজনকে শুলবিদ্ধ করা হবে এবং পাখিরা তার মাথা ঠুকরে ঠুকরে খাবে। - তোমরা যা জানতে চেয়েছিলে এ হলো তার ফায়সালা।’’
12-42 : দুই কারা সাথির মধ্যে যে মুক্তি পেয়ে যাবে বলে ইউসুফ মনে করলো, সে তাকে বললো: ‘তোমার মনিবের (রাজার) সাথে আমার কথা আলোচনা ক’রো।’ কিন্তু শয়তান তার মনিবের কাছে তার সম্পর্কে বলতে ভুলিয়ে দেয়। ফলে ইউসুফ কারাগারে আরো ক’বছর পড়ে থাকে।
12-43 : একদিন রাজা (তার সভাসদদের) বললো: ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি, সাতটি মোটাতাজা গরু। তাদের খেয়ে ফেলছে সাতটি শুকনো গরু। (আরো দেখেছি, ফসলের) সবুজ সাতটি শীষ আর শুকনো সাতটি শীষ। - হে আমার সভাসদেরা! তোমরা যদি স্বপ্নের তা’বির জানো, তবে আমার স্বপ্নের তাৎপর্য বলো।’
12-44 : তারা বললো: ‘এ এক তালগোল পাকানো (mixed up) বাতিল স্বপ্ন। তাছাড়া আমরা স্বপ্ন ব্যাখ্যায় পারদর্শী নই।’
12-45 : ইউসুফের কারা সাথিদের মধ্যে যে মুক্তি পেয়েছিল, দীর্ঘকাল পর এ সময় তার (ইউসুফের) কথা স্মরণ হলো। সে (রাজ সভায়) বললো: ‘আমি এ স্বপ্নের তাৎপর্য আপনাদের বলে দেবো, আমাকে (কারাগারে) পাঠান।’
12-46 : (সে কারাগারে এসে ইউসুফকে বললো:) হে ইউসুফ! হে সত্যবাদীতার প্রতীক! এই স্বপ্নের তাৎপর্য আমাদের বলে দিন: ‘সাতটি মোটাতাজা গরু। তাদের খেয়ে ফেলছে সাতটি শুকনো গরু। আর ফসলের সবুজ সাতটি শীষ এবং শুকনো সাতটি শীষ।’ এর তাৎপর্য বলে দিন, যাতে করে আমি ফিরে গিয়ে লোকদের বলতে পারি এবং তারা যেনো (আপনার সম্পর্কে) জানতে পারে।’
12-47 : ইউসুফ স্বপ্নের এই তাৎপর্য বলে দিলো: ‘‘তোমরা সাত বছর লাগাতার চাষাবাদ করে যাবে। এ (সাত বছর) সময় তোমরা যে ফসল কাটবে সেগুলো শীষ সমেত রেখে দেবে, তবে শুধুমাত্র তোমাদের আহারের জন্যে যে পরিমাণ দরকার, কেবল তাই শীষ থেকে ছাড়িয়ে নেবে।’’
12-48 : ‘‘তারপর আসবে কঠিন (দুর্ভিক্ষের) সাত বছর। এসময় জনগণ তোমাদের পূর্ব মওজুদকৃত ফসল খাবে। তবে এ থেকে তোমরা সঞ্চয়ে রাখলে সামান্যই রাখতে পারবে।’’
12-49 : ‘‘এরপর আসবে এমন একটি বছর, যে বছর মানুষ লাভ করবে প্রচুর বৃষ্টিপাত আর নিংড়াবে প্রচুর ফলের রস।’’
12-50 : (স্বপ্নের এই তা’বির শোনার পর রাজা ব্যতিব্যস্ত হয়ে) বললো: ‘তোমরা তাকে (ইউসুফকে) আমার কাছে নিয়ে আসো।’ রাজার দূত (ইউসুফের কাছে) উপস্থিত হলে সে বললো: ‘ফিরে যাও তোমার মনিবের (রাজার) কাছে। তাকে জিজ্ঞেস করো, যে নারীরা নিজেদের হাত কেটে ফেলেছিল, তাদের (চক্রান্তের) ব্যাপারে কী (ফায়সালা) করা হয়েছে? আমার প্রভু (আল্লাহ তায়ালা) তো তাদের চক্রান্ত সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছেন।’
12-51 : তখন রাজা তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলো: ‘হে নারীরা! তোমরা যখন ইউসুফকে অসৎ কর্মে ফাঁসাতে চেয়েছিলে, তোমাদের তখনকার ব্যাপারটা কী ছিলো?’ তারা বললো: ‘আল্লাহর কী মহিমা! আমরা তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অসৎ প্রবণতা দেখিনি।’ (এবার) আযীযের স্ত্রী বলে উঠলো: ‘এখন (সবার কাছে) সত্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। মূলত, আমিই তাকে অসৎ কাজে ফাঁসাতে চেষ্টা করেছিলাম। আর সে অবশ্য অবশ্যি সত্যবাদী।’
12-52 : (সত্য প্রকাশিত হওয়ায় ইউসুফ বললো:) ‘‘আমি এ জন্যে বিষয়টি তদন্ত (inquiry) করতে বলেছি, যাতে করে তিনি (আযীয মিশর) জানতে পারেন, আমি তার অনুপস্থিতিতে তার খেয়ানত করিনি। আর আল্লাহ তো কিছুতেই খিয়ানতকারীদের ষড়যন্ত্র সফলতায় পৌঁছান না।’’
12-53 : ‘‘আমি আমার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইছিনা, মানুষের নফস তো মন্দ কাজে প্ররোচিত করেই, তবে আমার প্রভু যদি কারো প্রতি দয়া করেন, সে - ই কেবল (এ প্ররোচনা থেকে) বাঁচতে পারে। অবশ্যি আমার প্রভু বড় ক্ষমাশীল, অতীব দয়ালু।’’
12-54 : রাজা বললো: ‘এবার ওকে আমার কাছে নিয়ে আসো। আমি তাকে নিজের জন্যে (ব্যক্তিগত সহকারি বা উপদেষ্টা) নিযুক্ত করবো।’ অতপর সে (রাজা) যখন তার সাথে কথা বললো, তখন (তার যোগ্যতায় বিমুগ্ধ হয়ে) বলে উঠলো: ‘(ইউসুফ) আজ থেকে তুমি আমাদের কাছে উচ্চ মর্যাদাশীল (high in rank) এবং পূর্ণ আস্থাভাজন (fully trusted)।’
12-55 : ইউসুফ বললো: ‘আমাকে দেশের সামগ্রিক ভান্ডারের উপর কর্তৃত্ব প্রদান করুন। আমি পূর্ণজ্ঞান ও দক্ষতার সাথে সবকিছু সংরক্ষণ ও পরিচালনা করবো।’
12-56 : এভাবে আমরা ইউসুফকে সে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রদান করলাম, যাতে করে সারা দেশের যেখানে যখন ইচ্ছা সে অবস্থান করতে পারে। মূলত যাকে ইচ্ছা আমরা আমার করুণাসিক্ত করে থাকি। আর আমরা উত্তম - পুণ্যবান লোকদের পুরস্কৃত করতে কসুর করিনা।
12-57 : তাছাড়া যারা ঈমানের ভিত্তিতে তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে, তাদের জন্যে আখিরাতের পুরস্কার অবশ্যি অতি উত্তম।
12-58 : (পরবর্তী সময়ের কথা,) ইউসুফের ভাইয়েরা (খাদ্য শস্যের জন্যে) মিশরে আসে এবং ইউসুফের কাছে উপস্থিত হয়। ইউসুফ তাদের (দেখেই) চিনে ফেলে, কিন্তু তারা তাকে চিনতে পারেনি।
12-59 : অতপর সে যখন তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সাজিয়ে দিলো, তখন (যাত্রার প্রাক্কালে তাদের) বললো: ‘‘তোমরা (আবার আসার সময়) তোমাদের বৈমাত্রেয় ভাই (বিনইয়ামিন) কে আমার কাছে নিয়ে এসো105। তোমরা দেখছোনা আমি পাত্র ভরে মেপে দিই, আর আমি একজন উত্তম অতিথি পরায়ণ?’’
12-60 : ‘‘(আবার আসার সময়) যদি তাকে না নিয়ে আসো, তবে আমার কাছে তোমাদের জন্যে রসদের কোনো বরাদ্দ থাকবেনা, আর তোমরা আমার কাছেও এসোনা।’’
12-61 : তারা বললো: ‘আমরা তাকে আনার ব্যাপারে তার পিতাকে সম্মত করার চেষ্টা করবো। আর একাজ আমরা করবোই।’
12-62 : ইউসুফ তার কর্মচারিদের বললো: ‘তারা খাদ্য শস্যের যে দাম দিয়েছে, সে অর্থ (গোপনে) তাদের পণ্য সামগ্রীর মধ্যেই রেখে দাও। এতে করে তারা নিজেদের পরিজনের কাছে ফিরে গিয়ে (যখন পণ্য সামগ্রী খুলবে, তখন আমরা যে দ্রব্যমূল্য ফেরত দিয়েছি, তা) জানতে পারবে এবং আমাদের দানশীলতা সম্পর্কেও জানতে পারবে। ফলে আশা করা যায় তারা আবার ফিরে আসবে।’
12-63 : অতপর তারা যখন তাদের পিতার কাছে ফিরে এলো, তাকে বললো: ‘বাবা! আমাদের জন্যে খাদ্য শস্যের বরাদ্দ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাই আমাদের ভাইকে এবার আমাদের সাথে পাঠান, যাতে করে আমরা খাদ্য শস্যের বরাদ্দ পাই। আমরা অবশ্যি তার হিফাযত করবো।’
12-64 : তাদের বাপ (ইয়াকুব) বললো: ‘ওর ব্যাপারে আমি তোমাদের প্রতি কি সেরকম আস্থা রাখবো, যেরকম আস্থা রেখেছিলাম ইতোপূর্বে ওর ভাইয়ের (ইউসুফের) ব্যাপারে? আল্লাহই সর্বোত্তম হিফাযতকারী এবং তিনিই সব দয়ালুর বড় দয়ালু।’
12-65 : অতপর তারা যখন তাদের পণ্য সামগ্রীর (বস্তা) খুললো, দেখতে পেলো, তাদের অর্থকড়ি ফেরত দেয়া হয়েছে। তখন তারা (আনন্দে চিৎকার করে) বলে উঠলো: ‘বাবা! আমরা আর কী চাই! এই যে দেখুন, আমাদের অর্থকড়ি ফেরত দেয়া হয়েছে। এখন আমরা আমাদের পরিজনকে (আরো) খাদ্যশস্য এনে দিতে পারবো। আমরা অবশ্যি আমাদের ভাইয়ের হিফাযত করবো এবং অতিরিক্ত এক উট (বিনইয়ামিনের উট) বোঝাই করে খাদ্য শস্য আনবো। এই পরিমাণ অধিক শস্য দেয়া (মিশর শাসকের জন্যে) খুবই সহজ।
12-66 : তাদের পিতা বললো: ‘আমি ওকে কখনো তোমাদের সাথে পাঠাবোনা, যতোক্ষণ না তোমরা এই মর্মে আল্লাহর কসম খেয়ে আমাকে কথা দেবে যে, তোমরা অবশ্যি তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবে। তবে তোমরা নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে পড়লে ভিন্ন কথা।’ অতপর তারা যখন এই মর্মে শপথ করে তাকে কথা দিলো, তখন সে বললো: ‘দেখো, আমরা যে বিষয়ে কথা স্থির করলাম, তার সাক্ষী স্বয়ং আল্লাহ।’
12-67 : সে (তাদের পিতা) আরো বললো: ‘হে আমার সন্তানেরা! তোমরা এক গেইট দিয়ে (এক পথে শহরে) প্রবেশ করোনা, বিভিন্ন প্রবেশ দ্বার দিয়ে প্রবেশ করবে। (তোমরা এভাবে সতর্ক হয়ে প্রবেশ করবে) তবে আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারবোনা। সর্বময় কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর। আমি নিজেকে তাঁর কাছেই ন্যস্ত করতে চাই, তাঁর কাছেই ন্যস্ত করা উচিত।’
12-68 : তারা যখন তাদের পিতার নির্দেশ মতো (বিভিন্ন প্রবেশ পথে শহরে) প্রবেশ করলো, এ (সতর্কতামূলক) ব্যবস্থা আল্লাহর ইচ্ছার মোকাবেলায় তাদের কোনো কাজে আসেনি। তবে ইয়াকুবের মনে এ ব্যবস্থার সুফল সম্পর্কে যে চিন্তার উদ্রেক হয়েছিল, এর ফলে তার সে ভাবনাটা পূর্ণ হয়েছে। অবশ্যি সে আমার প্রদত্ত শিক্ষায় জ্ঞানবান ছিলো। তবে অনেক মানুষই এ বিষয়ে অবগত নয়।
12-69 : তারা যখন ইউসুফের কাছে (কার্যালয়ে) পৌঁছে, ইউসুফ তার ভাই (বিনইয়ামিন) - কে নিজের কাছে নিয়ে নেয়। সে তাকে বলে: ‘আমি তোমার (হারানো) ভাই ইউসুফ। এরা যা কিছু (আমাদের সাথে) করে আসছে সে জন্যে এখন আর দুঃখ করোনা।’
12-70 : অতপর ইউসুফ যখন তাদের জন্যে পণ্যসামগ্রী প্রস্তুত করে (করায়) তখন তাদের পণ্যসামগ্রীর মধ্যে পানপাত্র রেখে দেয়। তারপর (তারা যাত্রা করলে) একজন ঘোষক চিৎকার করে ঘোষণা করে: ‘হে কাফেলার লোকেরা! তোমরা চোর।’
12-71 : তখন তারা ঘোষণাকারীদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করে: ‘আপনাদের কি জিনিস খোয়া গেছে?’
12-72 : তারা বললো: ‘আমরা রাজার পানপাত্র খুঁজে পাচ্ছিনা। যে তা এনে দেবে, সে এক উট বোঝাই পণ্য সামগ্রী পাবে। আর এর জিম্মা (দায়িত্ব) নিচ্ছি আমি।’
12-73 : তারা বললো: ‘আল্লাহর কসম, তোমরা তো জানো, আমরা তোমাদের দেশে অনাসৃষ্টি করতে আসিনি, আর চুরির সাথেও আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
12-74 : তারা (ইউসুফের লোকেরা) বললো: ‘তার (চোরের) কী শাস্তি হবে যদি তোমাদের কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়?’
12-75 : তারা জবাব দিলো: ‘(আমাদের আইনে) এর শাস্তি হলো যার পণ্য সামগ্রীর মধ্যে পান পাত্রটি পাওয়া যাবে, সে - ই এর বিনিময় (হিসেবে গ্রেফতার) হবে। আমাদের দেশে আমরা অন্যায়কারীদের এভাবেই শাস্তি দিয়ে থাকি।’
12-76 : তারপর সে ইউসুফের সহোদরের মালপত্রের পূর্বে তার সৎ ভাইদের মালপত্রের তল্লাশি শুরু করে। পরে তার সহোদরের পণ্যসামগ্রীর মধ্য থেকে পাত্রটি বের করে। এভাবে আমি ইউসুফের জন্যে কৌশল ঠিক করেছিলাম। মিশর রাজের প্রচলিত আইনে তার ভাইকে নিজের কাছে রেখে দেয়া সম্ভব ছিলনা। তবে আল্লাহ চাইলে ভিন্ন কথা। যাকে ইচ্ছা আমি মর্যাদা উঁচু করে দিই। আর প্রত্যেক জ্ঞান ওয়ালার উপরই সর্বজ্ঞানী (আল্লাহ) আছেন।
12-77 : (ইউসুফের সহোদরের বস্তায় পানপাত্রটি পাওয়ায় তার সৎ ভাইয়েরা) বলে উঠলো: ‘এ যদি আজ চুরি করে থাকে, তবে (এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, কারণ) ইতোপূর্বে তার এক সহোদরও (ইউসুফও) চুরি করেছিল।’ ইউসুফ (তাদের এই জঘন্য মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া) নিজের মনের মধ্যে হজম করে নিলো, তাদের সামনে প্রকাশ হতে দিলনা। (শুধু মনে মনে) বললো: ‘একেবারে নিকৃষ্ট পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছো তোমরা। যে জঘন্য দোষ তোমরা আমার প্রতি আরোপ করলে সে বিষয়ে আল্লাহই সর্বাধিক অবহিত আছেন।’
12-78 : তারা বললো: ‘হে আযীয ! এর একজন অতিশয় বৃদ্ধ পিতা আছেন। তাই আপনি ওর স্থলে আমাদের কোনো একজনকে রেখে দিন। আমাদের দৃষ্টিতে আপনি একজন মহানুভব - পরোপকারী ব্যক্তি।’
12-79 : সে (ইউসুফ) বললো: যার কাছে আমাদের জিনিস পেয়েছি, তাকে ছাড়া অন্য কাউকেও আঁটকানোর (মতো অন্যায়) কাজ থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। এমন কাজ করলে তো আমরা যালিম বলে গণ্য হবো।
12-80 : অতপর যখন তারা তার (ইউসুফের) কাছ থেকে সম্পূর্ণ নিরাশ হলো, তখন নির্জনে গিয়ে পরামর্শ করতে বসলো। তাদের বড়জন (বড়ভাই) বললো: ‘‘তোমাদের নলেজে কি নেই, তোমাদের পিতা আল্লাহর নামে তোমাদের কাছ থেকে একথার অংগীকার আদায় করেছেন (যে, তোমরা বিনইয়ামিনকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে নেবে)? ইতোপূর্বে তোমরা ইউসুফের ব্যাপারেও (পিতাকে কথা দিয়ে) কথা রাখতে পারোনি। তাই আমি (সিদ্ধান্ত নিয়েছি) আববার অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত এ দেশ ত্যাগ করবোনা, যতোক্ষণ না আল্লাহ নিজেই (বিনইয়ামিনকে মুক্ত করে) আমার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে দেন। কারণ, তিনিই তো সর্বোত্তম বিচারক।’’
12-81 : ‘‘তোমরা বাবার কাছে ফিরে গিয়ে তাঁকে বলো: বাবা! তোমার ছেলে চুরি করেছে। আমরা (ওকে চুরি করতে) দেখিনি, তবে যা জেনেছি তাই তোমাকে বলছি। আর না দেখা বিষয় তো আমরা হিফাযত করতে পারিনা।’’
12-82 : ‘‘আমরা যে বসতিতে ছিলাম সেখানকার লোকদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, যে কাফেলার সাথে আমরা ফিরে এসেছি তার লোকদের কাছে জেনে দেখুন, আমরা অবশ্যি সত্য বলছি।’’
12-83 : (তাদের বক্তব্য শুনে তাদের পিতা) ইয়াকুব বললো: ‘না, বরং তোমাদের নফস তোমাদের জন্যে একটা কাজকে সহজ করে দিয়েছে। সুতরাং ধৈর্য ধারণ করাই আমার জন্যে যথোপযুক্ত কাজ। হয়তো আল্লাহ ওদের সবাইকে একত্রে আমার সাথে মিলিত করে দেবেন। অবশ্যি তিনি সর্বময় জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মালিক।’
12-84 : সে তাদের সাথে কথা না বাড়িয়ে আত্মমগ্ন হয় এবং স্বগতোক্তি করে: ‘ইউসুফের জন্যে আমি শোকাভিভূত!’ এভাবে দুঃখ ও শোকে তার চক্ষুদ্বয় সাদা হয়ে যায়। আর মনোবেদনায় সে পীড়িত হয়ে পড়ে।
12-85 : তারা (ছেলেরা) বললো: ‘আল্লাহর কসম, মুমূর্ষু হয়ে পড়া, কিংবা মৃত্যু বরণ করা পর্যন্ত (মনে হয়) আপনি ইউসুফের স্মরণ থেকে বিরত হবেন না।’
12-86 : সে (ইয়াকুব) বললো: ‘‘আমি আমার দুঃখ - বেদনা ও মনস্তাপের অভিযোগ তো শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে নিবেদন করছি। আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তা জানি, যা তোমরা জানোনা।’’
12-87 : ‘‘হে আমার পুত্ররা! তোমরা যাও, গিয়ে ইউসুফ ও তার ভাইয়ের সন্ধান করো। আল্লাহর রহমত (mercy) থেকে নিরাশ হয়োনা। কাফিররা ছাড়া আর কেউই নিরাশ হয়না আল্লাহর রহমত থেকে।’’
12-88 : পুনরায় যখন তারা তার (ইউসুফের) কাছে উপস্থিত হলো, বললো: ‘হে আযীয! আমরা এবং আমাদের পরিবার পরিজন যারপর নাই বিপদের মধ্যে পড়েছি, আর সামান্য পূজি আমরা নিয়ে এসেছি। আপনি আমাদের পূর্ণ বরাদ্দ প্রদান করুন এবং আমাদের প্রতি দানের হাত বাড়িয়ে দিন! আল্লাহ অবশ্যি দানশীলদের পুরস্কৃত করে থাকেন।’
12-89 : সে (ইউসুফ) বললো: ‘তোমরা কি জানোনা, তোমরা ইউসুফ আর তার সহোদরের সাথে কী আচরণটা করেছিলে, যখন তোমরা ছিলে জাহিল?’
12-90 : তারা বললো: ‘তবে কি তুমি - তুমিই ইউসুফ?’ সে বললো: ‘আমিই ইউসুফ আর এ আমার সহোদর! আল্লাহ আমাদের প্রতি ইহ্সান করেছেন। যারা তাকওয়া আর সবর অবলম্বন করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সেইসব মুহসিনদের কর্মফল বৃথা যেতে দেন না।’
12-91 : তারা বললো: ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ তোমাকে আমাদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন আর আমরা অবশ্যি অপরাধ করে আসছি।’
12-92 : ইউসুফ বললো: ‘‘আজ আর তোমাদের বিরুদ্ধে (আমার) কোনো নিন্দা - ভৎর্সনা নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সবার সেরা দয়ালু।’’
12-93 : ‘‘তোমরা আমার এই জামাটি নিয়ে আববাজানের কাছে যাও এবং এটি তাঁর মুখমন্ডলে লাগাও, এতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আর তোমাদের পরিবার পরিজন সবাইকে নিয়ে আমার এখানে চলে আসো।’’
12-94 : তাদের কাফেলা যখন (মিশর থেকে) যাত্রা শুরু করলো, তখন তাদের পিতা পরিবারের লোকদের বলতে লাগলো: ‘তোমরা যদি আমাকে বৃদ্ধ বয়সের মতিভ্রম মনে না করো, তবে শুনো! অবশ্যি আমি ইউসুফের সুবাস পাচ্ছি।’
12-95 : তারা বললো: ‘আল্লাহর কসম, আপনি আপনার পুরোনো (বৃদ্ধ বয়সের) বিভ্রান্তির মধ্যেই নিমজ্জিত আছেন।’
12-96 : অতপর যখন আনন্দ সংবাদের বাহক এসে উপস্থিত হয়, সে ইউসুফের জামা ইয়াকুবের মুখমন্ডলে রাখে, আর সাথে সাথে সে দৃষ্টি শক্তি ফিরে পায়। সে বলে: ‘আমি কি তোমাদের বলিনি, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব বিষয় জানি, যা তোমরা জানোনা?’
12-97 : তারা বললো: ‘বাবা! আপনি আমাদের অপরাধ মাফির জন্যে (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করুন, আমরা অবশ্যি অপরাধে লিপ্ত ছিলাম।’
12-98 : সে (ইয়াকুব) বললো: ‘হ্যাঁ, আমি আমার প্রভুর কাছে তোমাদের মাফ করে দেয়ার জন্যে অচিরেই আবেদন জানাবো। নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল পরম করুণাময়।’
12-99 : অতপর তারা (মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে) যখন ইউসুফের কাছে (সীমানায়) এসে পৌঁছে, ইউসুফ (তাদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে এগিয়ে যায়), নিজের আববা আম্মাকে নিজের সাথে নিয়ে নেয় এবং (সবাইকে) বলে: ‘ইনশাল্লাহ, আপনারা নিরাপদ নিশ্চিন্তে মিশরে প্রবেশ করুন।’
12-100 : আর সে নিজের পিতা মাতাকে উচ্চাসনে উঠিয়ে নেয়। তখন তারা সবাই ইউসুফের প্রতি সাজদায় অবনত হয়। আর ইউসুফ তার পিতাকে বলে: ‘আববাজান! ইতোপূর্বে (ছোটবেলায়) আমি যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, এটাই সে স্বপ্নের তা’বিল (তাৎপর্য)। আমার প্রভু সেই স্বপ্নটিকে সত্যে পরিণত করেছেন। তাছাড়া আমার মহান প্রভু আমাকে কারাগার থেকে বের করে এনে এবং শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে দেয়ার পরও আপনাদের সবাইকে মরু অঞ্চল থেকে এখানে এনে আমার সাথে মিলিত করে দিয়ে আমার প্রতি বিরাট ইহ্সান করেছেন। আসলে আমার প্রভু যার প্রতি ইচ্ছা করেন, খুবই কোমল - দয়ালু হয়ে থাকেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞানী - প্রজ্ঞাময়।’’
12-101 : (ইউসুফ এসময় বিনয়ের সাথে দোয়া করে। দোয়ায়) সে বলে: ‘‘আমার প্রভু! তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো এবং আমাকে সকল কথার (কিংবা সকল বিষয়ের, অথবা স্বপ্নের) তাৎপর্য উপলব্ধি করার শিক্ষা দান করেছো! মহাবিশ্ব আর এই পৃথিবীর (একমাত্র স্রষ্টা তুমি! এই পৃথিবীর জীবনে এবং আখিরাতে তুমিই আমার অভিভাবক! তোমার প্রতি আত্মসমর্পণকারী হিসেবে আমাকে মৃত্যু দান করো, আর আমাকে সাথি বানিয়ে দাও সালেহ্ লোকদের।’’
12-102 : (হে মুহাম্মদ! এতোক্ষণ যে ইতিহাস তোমাকে জানানো হলো) সেটা একটা অদৃশ্য সংবাদ, যা অহির মাধ্যমে আমরা তোমাকে জানালাম। নতুবা তুমি তো আর সে সময় তাদের ওখানে উপস্থিত ছিলেনা, যখন তারা (ইউসুফের ভাইয়েরা ইউসুফের বিরুদ্ধে) একজোট হয়ে ষড়যন্ত্র পাকিয়েছিল।
12-103 : তবে তুমি যতোই উৎসুক হও না কেন, অধিকাংশ মানুষই কিন্তু মুমিন হবেনা।
12-104 : অথচ তুমি তো (আল্লাহর দিকে আহবান করার) একাজের বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে কোনো প্রকার পারিশ্রমিক দাবি করছোনা। এ (কুরআন) তো বিশ্ববাসীর জন্যে (মহাকল্যাণের) এক উপদেশ ছাড়া আর কিছুই নয়।
12-105 : দিনরাত তারা আসমান জমিনের কতো যে নিদর্শন অতিক্রম করছে, অথচ সেগুলোর ব্যাপারে তারা একেবারেই উদাসীন (সেগুলো সম্পর্কে মোটেও তারা ভেবে দেখেনা।)
12-106 : তাদের অধিকাংশই আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না, তবে রাখে মুশরিক অবস্থায়।
12-107 : আল্লাহর আযাব তাদের গ্রাস করে নেবেনা এবং হঠাৎ তাদের অজ্ঞাতে কিয়ামত সম্মুখে উপস্থিত হবেনা বলে কি তারা নিশ্চিত হয়ে গেছে?
12-108 : (হে মুহাম্মদ!) তুমি তাদের বলে দাও: ‘এটাই আমার পথ, আমি তোমাদের আল্লাহর দিকে ডাকছি দীপ্ত জ্ঞানের পূর্ণ আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে - আমি এবং আমার সাথিরা। আর আল্লাহ পবিত্র এবং আমি মুশরিকদের অন্তরভুক্ত নই।’
12-109 : (হে মুহাম্মদ!) তোমার আগেও আমি মানুষ ছাড়া আর কাউকেও রসূল বানিয়ে পাঠাইনি। তারাও জনপদেরই ছিলো বাসিন্দা, তাদের প্রতি আমি অহি পাঠিয়েছি। এরা কি পৃথিবী ভ্রমণ করে দেখতে পারেনা, তাদের আগেকার (যারা আমার নবীদের অমান্য করেছিল, সেইসব) লোকদের কী (করুণ) পরিণতি হয়েছিল? যারা আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করে, তাদের জন্যে আখিরাতের ঘরই উত্তম। এরপরও কি তোমাদের বোধোদয় হবেনা?
12-110 : (তাদের ধ্বংস করে দেয়ার কাজটি ততোক্ষণ পর্যন্ত বিলম্বিত করা হয়েছিল) যতোক্ষণ না রসূলেরা সম্পূর্ণ নিরাশ হয়েছে এবং ফায়সালায় উপনীত হয়েছে যে, তাদেরকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তারপর (যখন সে অবস্থা সৃষ্টি হয় তখন) রসূলদের পক্ষে আমার সাহায্য গিয়ে হাজির হয়। অতপর আমি যাকে চাই, তাকে বাঁচাই। কিন্তু অপরাধীদের উপর থেকে আমার শাস্তি প্রতিরোধ করার আর কেউই থাকেনা।
12-111 : আগেকার লোকদের (এসব করুণ) কাহিনীতে বুঝ - বুদ্ধি ওয়ালা লোকদের জন্যে রয়েছে এক বড় শিক্ষা (lesson)। (এই কুরআন) কোনো বানোয়াট বিবৃতি নয়। বরঞ্চ এটা হলো সেই শাশ্বত গ্রন্থ যা তার পূর্বে পাঠানো কিতাবের বক্তব্যকে সমর্থন করে এবং সকল বিষয়ের বিশদ বিবরণ প্রদান করে। তাছাড়া যারা (কুফরের পথ ত্যাগ করে) ঈমানের পথে আসে, এ কিতাব তাদের জন্যে পথ প্রদর্শক আর করুণাধারা।